শবে বরাত, যা লাইলাতুল বরাত নামেও পরিচিত, ইসলামি ক্যালেন্ডারের শাবান মাসের ১৪ তারিখের রাত। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই রাতকে মাগফিরাতের রাত বা নাজাতের রাত হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন বলে ধারণা করা হয়। তবে শবে বরাতের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। এ রচনায় কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হবে।
কোরআনের আলোকে শবে বরাত
অনেকেই মনে করেন, শবে বরাতের উল্লেখ কোরআনে পাওয়া যায়। বিশেষত, সূরা আদ-দুখান এর ৩ নম্বর আয়াতকে শবে বরাতের সাথে যুক্ত করা হয়। আয়াতটি হলো:
“إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ”
“নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী।” (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩)
অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ এই “লাইলাতুম মুবারাকা” বা “বরকতময় রাত” কে শবে বরাত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে অধিকাংশ মুসলিম পণ্ডিত ও তাফসিরকারগণ এই আয়াতকে লাইলাতুল কদর-এর সাথে সংযুক্ত করেছেন, যা রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটি। কোরআনের আরেক জায়গায়, সূরা আল-বাক্বারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে কোরআন রমজান মাসে নাযিল করা হয়েছে:
“شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ”
“রমজান মাস, যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।”
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে কোরআনে সরাসরি শবে বরাতের কোনো উল্লেখ নেই, বরং বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে।
হাদিসের আলোকে শবে বরাত
শবে বরাতের গুরুত্ব নিয়ে কিছু হাদিস পাওয়া যায়, তবে সেগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। নিচে কিছু প্রসিদ্ধ হাদিস উল্লেখ করা হলো:
১. আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা:
একটি বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“শাবান মাসের মধ্য রাত যখন আসে, তখন আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে মুক্তি দেব।’ এই অবস্থা ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে।”
(ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮)
হাদিস বিশ্লেষণ:
এই হাদিসটি জাঈফ (দুর্বল) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অনেক হাদিস বিশারদদের দ্বারা। তবে এটি বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ে প্রসিদ্ধ এবং এর মাধ্যমে শবে বরাতের রাতে ইবাদত, দোয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনার গুরুত্ব বোঝানো হয়।
২. শাবান মাসে আমলের গুরুত্ব:
হযরত আউসা ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“শাবান হলো এমন মাস, যে মাসে মানুষের আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই যে, যখন আমার আমল পেশ করা হবে, তখন আমি রোজা পালনরত থাকি।”
(নাসাঈ: ২৩৫৭)
হাদিস বিশ্লেষণ:
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে শাবান মাসে রোজা রাখা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। তবে এতে শবে বরাতের নির্দিষ্ট কোনো রাতের কথা বলা হয়নি।
শবে বরাতের ইবাদত
শবে বরাতের রাতে ইবাদত করা, নফল নামাজ আদায় করা, কোরআন তিলাওয়াত করা, জিকির-আসকার করা মুসলিম সমাজে প্রচলিত। যদিও এই রাতকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের কথা সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় না, তবে রাত জেগে ইবাদত করা এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অংশ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি রাতের কোনো অংশে আল্লাহর ইবাদত করে, আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষণ করেন।”
(বুখারি)
তাই শবে বরাতের রাতে ইবাদত করা ইসলামের সাধারণ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে।
বিদআত বা নতুন সংযোজন
শবে বরাতের নামে অনেকে এমন কিছু কাজ করে থাকেন, যা ইসলামে অনুমোদিত নয়। যেমন:
১. বিশেষ খাবার বিতরণ:
অনেকে এই রাতে হালুয়া-রুটি বা বিশেষ খাবার তৈরি করে বিতরণ করেন। যদিও দান-সদকা করা ইসলামে প্রশংসনীয়, তবে নির্দিষ্ট কোনো খাবার বা আয়োজন শবে বরাতের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
২. কবর জিয়ারতের নির্দিষ্টতা:
কবর জিয়ারত করা একটি সুন্নত, তবে শবে বরাতের রাতে বিশেষভাবে কবর জিয়ারত করা বাধ্যতামূলক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বছরের যেকোনো সময় কবর জিয়ারত করতেন।
৩. আতশবাজি বা আনন্দ আয়োজন:
শবে বরাতের রাতে আতশবাজি বা আনন্দ-উল্লাস করা ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি ইসলামী আধ্যাত্মিকতার বিপরীত।
শেষ কথা
শবে বরাত ইসলামী সমাজে বিশেষভাবে পালিত হয়। যদিও কোরআন বা সহিহ হাদিসে এই রাতের নির্দিষ্ট ফজিলতের স্পষ্ট উল্লেখ নেই, তবে এটি ইবাদত, দোয়া এবং আত্মসমালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। মুসলিমদের উচিত শবে বরাতকে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করা। বিদআত বা অতিরঞ্জিত প্রথা থেকে বিরত থেকে, শুদ্ধ ইসলামি শিক্ষার আলোকে এই রাতকে পালন করা সবার জন্য উত্তম।